ইমিউন সিস্টেমের বিরূপ এক প্রতিক্রিয়ার নাম ‘অ্যালার্জি’ যার সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোনো না কোনো অ্যালার্জি সমস্যায় ভোগেন নি এরূপ লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না বললেই চলে।
ব্যক্তিভেদে যেমন অ্যালার্জির কারন ও লক্ষণ ভিন্ন হয়। অনেকের যেমন অতিরিক্ত ধুলাবালির কারনে অ্যালার্জি হয়, কারো পশুপাখির লোমে, কারো খাদ্যজনিত কারণে ঠিক তেমনি কারো চুলকানি, কারো হাঁচির মাধ্যমে, কারো শ্বাসকষ্টের মাধ্যমেঅ্যালার্জির প্রকাশ পায়। অ্যালার্জির চিকিৎসাতেও রয়েছে নানা প্রকারভেদ তবে অ্যালার্জির তীব্রতার ওপর এর চিকিৎসা নির্ভর করে।
অ্যালার্জি কি?
মানবদেহে ইমিউন সিস্টেম একটি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা সিস্টেম যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরের জন্য ক্ষতিকর ভাইরাস,ব্যাকটেরিয়া প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করে।
মূলত অ্যালার্জি হলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমের এক অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। সাধারণত ইমিউন সিস্টেম আমাদের শরীরের জন্য আসলে ক্ষতিকর নয় কিন্তু ক্ষতিকর ভেবে এমন কিছু উপাদানের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে কাজ করে। সাধারণত যেসব উপাদান বা বস্তুর সংস্পর্শে অ্যালার্জির সৃষ্টি হয় তাকে অ্যালার্জেন (যেমন ধুলাবালি, ফুলের রেণু, পশুর লোম ইত্যাদি) বলে। যখন আমাদের শরীর কোনো অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে আসে তখন আইজিই অ্যান্টিবডি(খারাপ অ্যান্টিবডি) তৈরি হয় যা হিস্টামাইন জাতীয় রাসায়নিক নিঃসরণ করে এবং এর কারণেই অ্যালার্জির লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায়।
অ্যালার্জি কেন হয়?
সাধারণত অ্যালার্জেনের সংস্পর্শের কারনে অ্যালার্জি হয়। যেমনঃ
• গৃহপালিত পশু যেমন- বিড়াল, কুকুর ইত্যাদির পশম বা লোম অনেক সময় অ্যলার্জি সৃষ্টি করতে পারে।
• ওষুধের কারনেও অ্যালার্জি সৃষ্টি হয়। যেমন পেনিসিলিন এবং অ্যাসপিরিনজাতীয় ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত খাওয়া উচিত নয়।
• অতিরিক্ত ধূলো, দূষিত বায়ু, রঙের গন্ধ,চুনকাম ইত্যাদির কারনেও অনেকের অ্যালার্জি সৃষ্টি হতে পারে।
• খাদ্য যেমন গরুর মাংস,ইলিশ, বাদাম, দুধ, এবং ডিম ইত্যাদি অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে। এটি খাদ্য অ্যালার্জি নামে পরিচিত এবং ব্যক্তিবিশেষে খাদ্য ভেদে অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে।
• মৌমাছি,মশা,বোলতা, ভীমরুল প্রভৃতি পতঙ্গের দংশনে গায়ে চুলকানি, আক্রান্ত স্থানটি ফুলে যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে যা অ্যালার্জির বহিঃপ্রকাশ।
• গাছপালা ঘাস, আগাছা এবং গাছের পরাগ অ্যালার্জি সৃষ্টি করে।
• আর্টিকোরিয়া বা আমবাতও অ্যালার্জির একটি প্রকাশ যা এক প্রকার চর্মরোগ।
• মৌসুমী অ্যালার্জি যা খড় জ্বর নামেও পরিচিত। এ অ্যালার্জির লক্ষণগুলো হলো; সর্দি, কাশি, চোখ ওঠা, চোখের চুলকানি।
• অ্যালার্জির একটা প্রবণতা আছে। সেই প্রবণতার নাম হল অ্যাটোপি। এটা মূলত জেনেটিক মানে বংশ পরম্পরা সূত্রে হতে পারে।

অ্যালার্জির লক্ষণ
খাবারে অ্যালার্জি
• মুখের মধ্যে চুলকানি।
• ঠোঁট, মুখ, জিহ্বা এবং গলা বা শরীরের অন্যান্য অংশে চুলকানি
• শরীরের বিভিন্ন অংশে ফোলাভাব
• শ্বাসকষ্ট
• পেটে ব্যথা বা ডায়রিয়া
• বমি বমি ভাব বা বমি করা
• মাথা ঘোরা
• অজ্ঞান হওয়া
মৌসুমী অ্যালার্জি
যাদের মৌসুমি অ্যালার্জির সমস্যা আছে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সবুজ ঘাস, ফুলের রেণু, বাতাস, পুরনো কাপড়, উলের তৈরি পোশাক, ঘরের ধূলা বালি যেকোন কিছু থেকেই তারা অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হতে পারেন।
• হাঁচি
• সর্দি বা ভরা নাক
• চোখ দিয়ে পানি পড়া, চোখ চুলকানি।
• চুলকানি সাইনাস, গলা বা কানের খাল
• কান আটকে যাওয়া।
• মাথা ব্যাথা
• নিঃশ্বাসের দুর্বলতা
• কাশি

এ্যালার্জি হতে পরিত্রানের উপায়
• লাল লাল ফুসকুড়ি।
• শরীরের বিভিন্ন অংশে চুলকানি।
• শ্বাসকষ্ট।
• নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় নাকে শব্দ হওয়া।
• সর্দি বা নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া।
• কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস বা সংস্পর্শজনিত ত্বক প্রদাহ-
ফোসকা পড়া, ত্বকের বিভিন্ন অংশ লালচে হয়ে ওঠা, চুলকানি, চামড়া ফেটে যাওয়া,
• সোর থ্রোট- গলা জ্বালা, গলা ফুলে ইত্যাদি।
• একজিমা- ত্বকে প্রচন্ড চুলকানি, লালচে, চুলকানি বা খোঁচানোর ফলে আক্রান্ত স্থান থেকে রক্তপাত।
• অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস- চোখে চুলকানো চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়া, চোখ লাল হয়ে থাকা।
• আর্টিকোরিয়া- শরীরের বিভিন্ন অংশে ফোলা ভাব, চুলকানি এবং লালচে ভাব।
মারাত্মক অ্যালার্জি
অ্যানাফিল্যাক্সিস হলো মারাত্মক অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া যা মূহুর্তেই একটি জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে এবং মৃত্যুও ঘটাতে পারে। অ্যানাফিল্যাক্সিসের ক্ষেত্রে সাধারণত শ্বাসকষ্ট, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, চুলকানিযুক্ত ফুসকুড়ি এবং নিম্ন রক্তচাপসহ কয়েকটি লক্ষণ প্রকাশ পায়। সাধারণত পোকামাকড়ের দংশন বা কামড়, খাবার এবং ঔষধের মাধ্যমে অ্যানাফিল্যাক্সিসের সৃষ্টি হয়তবে এর প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ইপিনেফ্রিন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়।
অ্যালার্জিযুক্ত খাবারের তালিকা
• গরুর মাংস
• ইলিশ মাছ
• চিংড়ি মাছ
• শেলফিশ (যেমন কাঁকড়া,শামুক ইত্যাদি)
• দুধ এবং দুগ্ধজাতীয় খাবার।
• ট্রি নাটস (যেমন কাজু, পেস্তা, আখরোট ইত্যাদি)
• ডিম
• গম
• বেগুন
• গাজর
• টমেটো
• চিনাবাদাম
• সয়া
অ্যালার্জি চিকিৎসা
অ্যালার্জি এড়ানোর সর্বোত্তম উপায় হলো অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া শুরু করে এমন সব কিছু থেকে দূরে থাকা। যদি এটি সম্ভব না হয় তবে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ থাকা।
প্রায়শই লক্ষ্য করা যায় অ্যালার্জির চিকিৎসায় এর লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে অ্যান্টিহিস্টামাইন জাতীয় ঔষধগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে অ্যালার্জির তীব্রতার উপর এর চিকিৎসা নির্ভর করে।
অ্যালার্জির ওষুধগুলির মধ্যে রয়েছে:
• অ্যান্টিহিস্টামাইনস
• কোর্টিকাস্টোরয়েডস
• সাটেরেজিন
• লর্যাটাডিন
• ক্রোমোলিন সোডিয়াম
• ডিকনজেস্ট্যান্টস
• লিউকোট্রিন মোডিফায়ারস
ইমিউনোথেরাপি
অ্যালার্জির চিকিৎসায় অনেকেই ইমিউনোথেরাপিকে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে বেছে নেন। তবে একেক চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপির সংজ্ঞা একেক রকম। সাধারণত এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে আপনার যে উপাদান বা অ্যালার্জেনের কারনে অ্যালার্জির লক্ষণ প্রকাশ পায়, সেই উপাদান বা সদৃশ কোনো বস্তু ইনজেকশনের মাধ্যমে আপনার শরীরে প্রবেশ করানো হয় ধীরে ধীরে। এটি বেশ দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি। সফল ইমিউনোথেরাপি হলে আপনার যে উপাদানে অ্যালার্জির লক্ষণগুলি প্রকাশ পেত সেগুলো আর প্রকাশ পাবে না।
ইপিনেফ্রিন
যাদের তাৎক্ষণিক মারাত্মক অ্যালার্জির প্রকোপ রয়েছে তাদের কাছে ইপিনেফ্রিন আশীর্বাদস্বরূপ। তাৎক্ষণিক ত্বকের তীব্র চুলকানি, আমবাত এবং অ্যালার্জির অন্যান্য প্রতিক্রিয়ার (অ্যানাফিল্যাক্সিস) জন্য ইপিনেপ্রিন ব্যবহার করা হয়। এই চিকিৎসার সাধারণ ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে এপিপেন এবং টুইনজেক্ট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অ্যালার্জির প্রাকৃতিক প্রতিকার
অন্যান্য রোগের চিকিৎসার ন্যায় অ্যালার্জির চিকিৎসাতেও প্রাকৃতিক প্রতিকার রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিম পাতার কথা। নিম গাছের গুনাগুন সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। অ্যালার্জি চিকিৎসায় নিম পাতা অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে ভিটামিন সিও একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিহিস্টামাইন হিসাবেও কাজ করে।
এছাড়াও গ্রিন টি, মধু, অ্যাপল সাইডার ভিনেগার ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, গ্রেপ সীড এক্সট্রাক্টও অ্যালার্জির চিকিৎসায় যথেষ্ট উপকারী।
তবে এগুলি চেষ্টা করার আগে আপনাকে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিতে হবে। অন্যথায় প্রাকৃতিক উপাদানে উপস্থিত যে কোন অ্যালার্জেনের কারনেও আপনার অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া কমানোর বদলে বাড়িয়ে দিতে পারে।